তায়েফ চমৎকার সাজানো গোছানো শহর
মক্কা থেকে তায়েফের দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ হাজার ৩৩২ ফুট।
পুরো শহরটিই গড়ে উঠেছে পাহাড়ের ওপর। মক্কা থেকে প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা সময় লাগে তায়েফ আসতে। পথে উট-দুম্বা ও
ছাগলের পাল দেখা যায়। বাদশা ফয়সাল ও বাদশা খালেদের আমলে শীতকালীন রাজধানী হিসেবে গণ্য করা হতো তায়েফকে।
বাদশা খালেদের শাসনামলে ওআইসির শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। রবিশস্য ও নানান ফল-ফলাদির জন্য তায়েফ বিখ্যাত।
তায়েফে উৎপন্ন আঙুর, কমলা, আনার ইত্যাদি ফলফলাদি মিষ্টি ও পুষ্টিতে ভরপুর। বিশেষ করে তায়েফের আঙুর খুব বিখ্যাত।
তায়েফের উৎপাদিত সবজি সৌদি আরবের চাহিদার প্রায় ৩০ ভাগ পূরণ করে।
তায়েফ চমৎকার সাজানো গোছানো শহর। মক্কা থেকে তায়েফের রাস্তাগুলো পাহাড়ের বুক চিরে তৈরি করা। পাহাড় কেটে বানানো
রাস্তাটি একমুখী। তায়েফের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যায়, ঝকঝকে নীল আকাশ। মরুর দেশে এমন নীল আকাশের কথা
চিন্তা করা যায়?
রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত শহর তায়েফ ইতিহাসের পাতায় তায়েফ নানা কারণে আলোচিত। এই তায়েফের বনি সাকিফ
গোত্রে নবী করিম (সা.) দুধমাতা হজরত হালিমা সাদিয়ার ঘরে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। এখন সেই বাড়ি-ঘরের কোনো চিহ্ন নেই।
তারপরও একটি পাহাড়ের পাদদেশকে অনেকে হালিমার বাড়ি বলে সেখানে গিয়ে নামাজ পড়েন। পাশের পাহাড়টিতে নবী করিম (সা.)
বকরি চড়িয়েছেন বলে মনে করে সেখান থেকে মাটি আনেন।
নবুওয়তপ্রাপ্তির পর হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে তায়েফ এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তায়েফবাসী ইসলাম
গ্রহণের পরিবর্তে নবীকে অত্যাচার করেছে। ইসলাম প্রচার করতে এসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তায়েফে প্রায় ১০ দিন অবস্থান
করেছিলেন। তারপর ফিরে গেছেন তায়েফবাসীর নানা নির্যাতন সহ্য করে। রক্তাক্ত অবস্থায় নবী করিম (সা.) যেখানে আশ্রয়
নিয়েছিলেন, সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদের নাম মসজিদে আব্বাস।
প্রাচীনকাল থেকে মক্কা ও তায়েফবাসীর ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আব্বাস (রা.) তায়েফের সঙ্গে
ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। পরে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) তায়েফের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যান।
তায়েফের প্রধান মসজিদকে ইবনে আব্বাস মসজিদ বলা হয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর কবর
মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে। এ কবরস্থানে আরও অনেক সাহাবির কবর রয়েছে। মসজিদ সংলগ্ন একটি লাইব্রেরি আছে।
সেটা অবশ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। তবে সেখানে প্রাচীন অনেক কিতাবের সংগ্রহ আছে।
রয়েছে হজরত আব্বাস (রা.)-এর হাতের লেখা কোরআনের কপিসহ বিভিন্ন সময়ে পাথর ও কাগজে লিখিত কোরআনের প্রাচীন কপি।
তায়েফ শহরে রয়েছে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে তৈরি করা চমৎকার সব রিসোর্ট, পার্ক আর অবকাশ যাপনকেন্দ্র।
পর্যটকদের আনন্দ দিতে রয়েছে পাহাড়ে ক্যাবল কারের ব্যবস্থা। তায়েফের প্রবেশপথে ওকাজ নামক স্থানে রয়েছে
ফলমূলের বিশাল বিশাল দোকান, বাচ্চাদের খেলার মাঠ। এখানে ভাড়ায় মরুভূমির জাহাজ উটে সওয়ার করা যায়।
রাস্তার পাশে বানরের দল দেখা যায়।
সাফা মারওয়ায় দৌড়ানোর ইতিহাস
সৌদি আরবের মক্কায় অবস্থিত দুটি ছোট পাহাড়। এই পাহাড়দুটি হজ ও উমরার সাথে সম্পর্কিত। হজও উমরার অংশ হিসেবে এই দুই পাহাড়ের মাঝে সাত বার আসা যাওয়া করতে হয়। জনশ্রুতি আছে, হজরত হাজেরা (আ.) এবং শিশু পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কাবার পাশে বড় একটি গাছের ছায়ায় রেখে যান হজরত ইব্রাহিম (আ.)। তখন কাবা শরিফের স্থানটি ছিল উঁচু একটি টিলার মতো। তাঁদের দিয়ে যান কিছু খেজুর আর এক মশক পানি। পানি ফুরিয়ে গেলে হজরত হাজেরা (আ.) পানির জন্য কাবার সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় ছোটাছুটি করতে থাকেন। সাতবার ছোটাছুটির পর একটি আওয়াজ শুনে তিনি কাবার পাশে এসে দেখেন, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে পানি। তিনি পানির উৎসে চারদিকে বালির বাঁধ দেন। পরে খনন করে এই কূপকে আরও প্রশস্ত করেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)। এইটাই সাফা মারওয়ায় দৌড়ানোর ইতিহাস।
মিকাত
মিকাত হলো হজ সংক্রান্ত কিছু স্থান। এসব স্থান অতিক্রম করার আগেই হজযাত্রীদের ইহরাম করতে হয়। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আগত হজযাত্রীদের হিসেবে একেকটি মিকাত রয়েছে। হজ ও উমরা পালকারীদেরকে কাবা শরিফ হতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্বে থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়, যে স্থানগুলো রাসূল (সা.) নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ঐ জায়গাগুলোকে মিকাত বলা হয়। মিকাত ৫টি : ১. যুল হুলায়ফা। ২. যাতে ইরাক। ৩. যুহফাহ। ৪. কারনুল মানাযেল। ৫. ইয়ালামলাম।
মসজিদে কিবলাতাইন
মসজিদে কিবলাতাইন
নামাজ আদায়ের দিকনির্দেশকে কিবলা বলা হয়। আর দু’টি কিবলা বুঝানো হয় ‘কিবলাতাইন’ শব্দ দিয়ে।
‘মসজিদ কিবলাতাইনে’ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামাজ আদায়ের মাঝামাঝি সময়ে কিবলা পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে।
এজন্য মসজিদটির নাম ‘মসজিদ কিবলাতাইন’। অর্থাৎ দুই কিবলার মসজিদ। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনায়
হিজরত করেন ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর। হিজরতের দ্বিতীয় বছরের রজব মাসের মাঝামাঝি সময়ে কিবলা
পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। গবেষকদের মতে, কিবলা পরিবর্তনের দিন হজরত মুহাম্মদ (সা.) এই মসজিদে জোহর কারো
কারো মতে আসর নামাজ আদায় করছিলেন। জেরুজালেম নগরীর বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদমুখি হয়ে নামাজ আদায় করছিলেন তিনি।
দুই রাকাত নামাজ শেষ করেছেন। ঠিক এমন সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে হজরত জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে নির্দেশ আসে কিবলা
পরিবর্তনের। রাসূল (সা.)-কে মক্কা নগরীর পবিত্র কাবামুখি হয়ে নামাজ আদায়ের নির্দেশ জানিয়ে দেন হজরত জিবরাইল (আ.)।
এই নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে রাসূল (সা.) নামাজের মধ্যেই কিবলা পরিবর্তন করেন। সাথে সাথে পরিবর্তন করেন তার পেছনে
নামাজ আদায় করতে থাকা সাহাবিরা। কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ ঘটনাটি উল্লেখ আছে সূরা বাকারার ১৪৪ নম্বর আয়াতে।
চলবে ..........